IQNA

আয়েশা কুরতুবিয়া

মুসলিম স্পেনের অবিস্মরণীয় নারী কবি

0:02 - November 27, 2022
সংবাদ: 3472888
তেহরান (ইকনা): আয়েশা বিনতে আহমদ কুরতুবিয়া ছিলেন হিজরি চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও লেখিকা। মুসলিম স্পেনের ইতিহাসে যিনি ‘উখতুর রিজাল’ নামে খ্যাত। আয়েশা কুরতুবিয়া ছিলেন মুসলিম স্পেনের স্বর্ণযুগের অন্যতম সাক্ষী। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্পেনের উন্নয়ন উত্থানকাল দেখেছেন এবং তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন।
হিজরি চতুর্থ শতকে স্পেনে অসংখ্য গুণী লেখক, সাহিত্যিক ও কবি জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁদের ভেতর আয়েশা বিনতে আহমদ কুরতুবিয়া ছিলেন অনন্য মর্যাদার অধিকারী। তিনি স্পেনের স্বর্ণযুগে, যখন প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ছিল অত্যন্ত প্রবল, তখন তিনি যুগের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন এবং ইতিহাসে নিজের নাম অবিস্মরণীয় করে তোলেন। অবশ্য পারিবারিকভাবে তিনি জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে অনুকূল পরিবেশ পান। হিজরি সপ্তম শতক পর্যন্ত তাঁর পরিবারকে জ্ঞানচর্চায় নেতৃস্থানীয় মনে করা হতো।
মুসলিম স্পেনে নারীদের জ্ঞানচর্চা : স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নারীরা মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সুযোগ পান। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য সর্বত্র তাদের পদচারণ লক্ষ করা যায়। বিশেষত ধর্মীয় জ্ঞান, কবিতা ও সাহিত্যে। সমাজেও ছিল কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিদদের বিশেষ মর্যাদা। ফলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হন। এমনকি তাঁরা হস্তাক্ষর ও ক্যালিগ্রাফিশিল্পেও বিশেষ অবদান রাখেন।
 
সাহিত্য সমালোচকদের চোখে : ‘মুকতাবিস’ প্রণেতা ইবনে হাইয়ান আয়েশা কুরতুবিয়া সম্পর্কে লেখেন, তাঁর সময়ে আন্দালুসের স্বাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহিত্য, কবিতা ও অলংকারশাস্ত্রে তাঁর সমকক্ষ ছিল না। তিনি শাসকবর্গের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছেন এবং কবিতায় তাদের উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল চমৎকার এবং তিনি কোরআনের অনুলিপি তৈরি করতেন।
 
‘আল-মুগরিব’ গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, তিনি ছিলেন নিজ সময়ের বিস্ময়কর ও বিরল প্রতিভা। যদি বলা হয়, তিনি তাঁর চাচা ও বিখ্যাত কবি আবু আবদুল্লাহ আত-তাইয়িবের চেয়ে বড় কবি ছিলেন, তবে তা অত্যুক্তি হবে না।
 
সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য : আয়েশা কুরতুবিয়ার কবিতা ও সাহিত্যে জ্ঞান গভীরতা ও পাণ্ডিত্যের ছাপ স্পষ্ট। পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন আয়েশা কুরতুবিয়া ছিলেন জ্ঞানের বহু শাখায় বিচরণকারী। তাঁর কবিতা ছিল অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। কবিতা রচনায় তিনি যেমন ছিলেন স্বতস্ফূর্ত, তেমনই ছিলেন কুশলী। ভাব ও ভাষা, শব্দ ও অলংকারের অপূর্ব সম্মিলন ছিল তাঁর কবিতা। কথাশিল্পী হিসেবেও পাঠকপ্রিয় ও প্রভাবশালী।
 
ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক : আয়েশা কুরতুবিয়ার হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। তিনি কোরআনের অনুলিপি তৈরি করতেন। নিজের বইয়ের অনুলিপিও প্রস্তুত করতেন। বইয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। ফলে বইয়ের বিপুল সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন নিজ বাড়িতে।
 
তিনি শাসক ও নেতৃস্থানীয়দের কাছে যেতেন এবং তাদের প্রশংসা বা নিন্দায় কবিতা রচনা করতেন। কবিতায় কবিতায় তাদের সামনে নিজের দাবি তুলে ধরতেন। তিনি তাদের সুপরামর্শ দিতেন। কখনো কখনো শাসকশ্রেণি তাঁকে ডেকে পাঠাত এবং তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করত। আয়েশা কুরতুবিয়া অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। কাউকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে সংকোচ করতেন না। যেমন—একজন শাসকের উদ্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন, ‘যদি চোখের পানি না থাকত আমি কোনো অজুহাতকে ভয় পেতাম না। কেননা তারাই তোমার (পতনের) পথ তৈরি করছে। ’
 
পারিবারিকভাবে তিনি ধনী ছিলেন। অসহায় ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে নিজের সমুদয় অর্থ ব্যয় করেন। অনন্য মর্যাদার অধিকারী হওয়ার পরও আয়েশা কুরতুবিয়া কখনো বিয়ে করেননি।
 
আধুনিক যুগের স্বীকৃতি : প্রখ্যাত স্প্যানিশ সাহিত্য সমালোচক অ্যাঞ্জেল গোঞ্জালেজ প্যালেন্সিয়া আয়েশা কুরতুবিয়ার প্রশংসায় বলেন, আন্দালুসের নারীদের মুখে মুখে কবিতা গুঞ্জরিত হতো। নারীদের মধ্যে যাঁরা কাব্যচর্চায় দক্ষতা অর্জন করেন, আয়েশা বিনতে আহমদ তাঁদের অন্যতম। ২০০২ সালে সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত আরামকো ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় আয়েশা বিনতে আহমদ কুরতুবিয়াকে মুসলিম ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ব্রুকলিন মিউজিয়ামের হ্যারিটেজ ফ্লোরে তাঁর নাম স্থান পেয়েছে। যেখানে পৃথিবীর বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ৯৯৯ জন নারীর নাম লেখা হয়েছে।
 
মৃত্যু : ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সময় তিনি শহীদ হন।
 
তথ্যঋণ : নুজহাতুল জুলাসা ফি আশআরিন-নিসা, ইসলামস্টোরি ও উইকিপিডিয়া
captcha