IQNA

মুসলিম শাসনামলে স্পেনের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন ছিল

0:02 - January 25, 2023
সংবাদ: 3473228
তেহরান (ইকনা): স্পেনে মাদরাসাভিত্তিক শিক্ষার ইতিহাস পাওয়া যায় হিজরি পাঁচ শতকের গোড়ার দিকে। এর আগে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মসজিদ কিংবা ঘর ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো। এ বিষয়ে স্পেনবিষয়ক লেখন আল মাক্কারির উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যবহৃত এমন কোনো মাদরাসা যথার্থ অর্থে স্পেনে ছিল না। বরং বৈতনিক ব্যবস্থায় স্পেনবাসী পড়ালেখা করত মসজিদে।’ (আল মাক্কারি, শায়খ আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ, নাফহুততীব মিনি গুসনিল আন্দালুসির রাতিব, কায়রো, দারুল ফিকর, ১৯৮৬, প্রথম সংস্করণ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৩০)
তবে স্পেনবিষয়ক গবেষক রেজা সাইদ বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানিয়েছেন, আরবরা স্পেনের কর্ডোভা, সেভিল, গ্রানাডা, মালাগা প্রভৃতি অঞ্চলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্পেনে বৃহৎ পরিসরের ১৭টি মাদরাসা ছিল এবং ১২০টি ছোট আকারের মাদরাসা ছিল। (মুকবিল, ড. রেজা সাইদ, তারিখুল মাকতাবাতি ফিল আন্দালুস, দ্বিতীয় সংস্করণ, মাকতাবাতুস সাকাফাতুদ দ্বিনিয়্যাহ, কায়রো, ২০০৯, পৃষ্ঠা ৪৬)
 
শুধু খেলাফত আর মুসলিম শাসকদের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে নয়, মুসলিম স্পেনের ছিল আরো ভিন্ন পরিচয়। একসময় মুসলিম স্পেন আরবি সাহিত্যচর্চা, তাফসিরচর্চা, হাদিসচর্চা, ইতিহাসচর্চা, গ্রন্থাগার স্থাপন ও বিজ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এগুলোর চর্চায় মুসলিম স্পেন ছিল গোটা বিশ্বের নেতৃত্বে। স্পেনে মুসলমানরা ছিল শতভাগ শিক্ষিত। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয়ের জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রেও মুসলমানরা গোটা পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সে সময় পৃথিবীর বিখ্যাত তিনটি প্রধান গ্রন্থাগার ছিল। একটি আব্বাসীয় খলিফাদের গ্রন্থাগার, দ্বিতীয়টি মিসরের ফাতেমীয়দের গ্রন্থাগার ও তৃতীয়টি স্পেনে উমাইয়াদের গ্রন্থাগার। এ লাইব্রেরিতে ৪০ লাখের বেশি গ্রন্থের মজুদ ছিল। ঐতিহাসিক ইমামউদ্দিন বলেন, ওই লাইব্রেরিতে ৬০ লাখের বেশি গ্রন্থ ছিল। (ড. মুহাম্মদ ফরিদুদ্দিন ফারুক, স্পেনে মুসলিম ইতিহাস ও কীর্তি, পৃষ্ঠা ২৮২)
 
আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে স্পেনের মুসলমানদের নজিরবিহীন ভূমিকা ছিল। গণিত, চিকিৎসা, ভূগোল ও রসায়নে মুসলমানদের অসামান্য অবদান রয়েছে। ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলিম স্পেনের প্রভাব কতটা বিস্তৃত ছিল—পি কে হিট্টির একটি উদ্ধৃতি থেকে তা জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘লেখার কাগজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ইউরোপের প্রতি ইসলামের সবচেয়ে উপকারী অবদান।’ (P K Hitty, Histori of the Arabs, London, p. 562) ইউরোপ ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে শুধু সভ্যতাই শেখেনি, মুসলমানদের ব্যবহৃত বহু শব্দও গ্রহণ করেছে। যেমন—Cotton (সুতা), Gause (গ্যাস), Syrup (সিরাপ), Jar (জার), Sofa (সোফা),  Lemon (লেমন),  Suger (চিনি), Coffee (কফি),  Rice (চাল) ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ এসেছে আরবি শব্দগুচ্ছ থেকে।
 
খলিফা হাকাম আল-মুনতাসীর নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শুধু রাজধানীতেই ২৭টি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিঃস্ব অভিভাবকদের তিনি শিক্ষাব্যয়ের জন্য দান করতেন অকাতরে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে বিনা পয়সায় বই-পত্র দেওয়ারও তিনি ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমলেই কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। অনেকের মতে, এটা কায়রোর আল-আজহার এবং বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসার চেয়েও উন্নত ছিল।
 
 
ঐতিহাসিক ডজি তখনকার মুরীয় স্পেন ও ইউরোপের চিত্র তুলে ধরেন এভাবে : In Spain almost everybody knew how to read and write, whilst in Christian Europe, save and except the clergy, even parsons belonging to highest ranks were wholely ignorant. (History of the Saracens -A. Ali.) স্পেনে প্রায় সবাই পড়া ও লেখা জানত, তখন খ্রিস্টান ইউরোপে পুরোহিত সম্প্রদায় ছাড়া সবাই ছিল নিরেট মূর্খ। এমনকি উচ্চ পদের ব্যক্তিরাও! অন্য কথায় মুরদের আগমন, রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশ তখনকার দিনে স্পেনে না ঘটলে আজও বোধ হয় স্পেন শিক্ষা ও সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত থাকত। এর পরিণতিতে গোটা ইউরোপও নিকষ কালো আঁধারে নিমজ্জিত থাকত।
captcha