IQNA

‘খুব ভীত ছিলাম, যদি কেউ হিজাব পরিহিত দেখে ফেলে এবং মা বাবাকে বলে দেয়’

18:53 - April 02, 2019
সংবাদ: 2608252
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এই পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং একই সাথে আমার মত এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত মানুষেরও অভাব নেই। কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে, আমার মত ১৭ বছর বয়সী ল্যাটিন-আমেরিকান নারী যে খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এরকমটি খুব কমই ঘটেছে।

বার্তা সংস্থা ইকনা: আর এর সবকিছু শুরু হয়েছে যখন আমি আমার পরিবারের সাথে মেক্সিকোর একটি শহর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পাড়ি জমাই। আমি নিউইয়র্কে এসে এখানকার বহু সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হই।

আমি এখানে দক্ষিণ এশিয়ান ঐতিহ্যের অংশ সালওয়ার কামিজ এবং হিজাব পরিধানকারী অনেক নারী দেখতে পাই। আর এখানে এসে আমি প্রার্থনার জন্য আহ্বান করার শব্দ শুনতে পেয়ে খুব কৌতূহলী হয়ে পড়ি যা শুনতে অনেকটা এরকম ছিল ‘আল্লাহু আকবার।’

এর পরে আমি অনলাইনে এ সম্পর্কে আরো তথ্য খুঁজতে থাকি এবং আমি জানতে পারি যে, এ ধরনের পোশাক এবং প্রার্থনা করার জন্য আহ্বানের শব্দ ইত্যাদি ইসলামের অংশ। এর পূর্বে আমি যেটিকে শুধুমাত্র আরবদের ধর্ম বলে মনে করতাম এবং গণমাধ্যম গুলোতে আমি দেখেছিলাম যে, এ ধর্মের অনুসারীরা সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালিয়ে এখানকার নারী, পুরুষ এবং শিশুদেরকে হত্যা করেছিল।

আমি এসব দেখে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি বিশেষত আমি যখন জানতে পারি যে, বিশ্বব্যাপী কয়েক মিলিয়ন মুসলিম এই ধর্মের অনুসারী। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি ‘কিভাবে মানুষ এমন একটি ধর্ম অনুসরণ করে যা হত্যা করতে শেখায়? এবং এটি কি সত্যি যে, তারা যিশু খ্রিষ্টে বিশ্বাস করে না।’

আমি সত্য জানতে চেয়েছিলাম এবং এ সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেছিলাম। আমি ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখেছিলাম যেখানে অনেকে পবিত্র কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে, পবিত্র কুরআন অমুসলিমদের হত্যা করতে মুসলিমদের উৎসাহ দেয়।

আমি এর পরে নিজেই পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন শুরু করি এবং দেখতে পাই যে, এখানে এমন আয়াত রয়েছে যা মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, তুমি যদি বিনা কারণে কোনো মানুষ হত্যা কর তবে তা পুরো মানব জাতিকে হত্যা করার সামিল।

আমি তখন বুঝতে পারি, লোকজন শুধুমাত্র সেই বিষয়টি দেখে যা তারা দেখতে চায়। কিছু মুসলিম ধর্মের নামে খারাপ কাজ করে কিন্তু আমি মনে করি তারা সত্যিকার অর্থেই খারাপ মানুষ। আমার নিকট ইসলাম হচ্ছে, প্রার্থনা করা এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করার একটি ধর্ম।

একটি শান্ত আত্মা
আমি ইসলাম সম্পর্কে জানতে এতটা আগ্রহী হয়ে পড়ি যে, আমি এর শিক্ষা সমূহ বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমি সৃষ্টিকর্তার জন্য প্রার্থনা করার এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করি যা সম্পর্কে আমি ইতোপূর্বে জানতাম না।

আরব সংস্কৃতি বা পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করে প্রভাবিত হয়ে আমি মুসলিম হয়ে যাইনি বরং আমি ইসলাম ধর্মের প্রার্থনা করার অপরূপ রূপ দেখেই এ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হই। যখনই আমি আজানের ধনি শুনতে পাই তখনই আমার হৃদয় শান্ত হয়ে যায়।

আমি সালাত সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্টিকেল এবং ভিডিও দেখতে শুরু করি। ঘরে যখন কেউ থাকত না আমি তখন নিজে নিজে প্রার্থনা করার চেষ্টা করতাম। আমি সালাতের সব নিয়ম অনেক সময় ভুলে যেতাম এবং আমি তখন এ সম্পর্কিত ভিডিও’র উপর নির্ভর করতাম।

আমি ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু সামনের বাধা সমূহের ব্যাপারে ভীত ছিলাম। অন্যান্য মুসলিমগণ আমাকে গ্রহণ করে নিবেন কিনা? যদিও বিদ্যালয়ে আমার অনেক মুসলিম বন্ধু ছিল কিন্তু তাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করতে আমি সাহস পেতাম না।

মসজিদে আমার প্রথম ভ্রমণ
এক সময় আমি আমার ঘরের পাশের মসজিদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি হতাশ হয়ে হাঁটতে থাকি এবং আমার চারপাশে হিজাব পরিহিত অনেক নারী দেখতে পাই। কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পাই কেউ একজন বলছেন- ‘হে, আমি নীল স্কার্ফ এবং লম্বা কালো পোশাক পরিহিত একজন তরুণ মেয়েকে খুঁজছি।’

আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলেছিলাম- ‘ওহ, আমি একজন মেক্সিকান, আমি মুসলিম হতে চাই’।

তিনি উত্তরে বললেন- ‘সুবহান আল্লাহ’। এরপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং উচ্চ স্বরে আরবি ভাষায় কথা বলতে থাকেন, আর তখন সকলে আমার দিকে তাকিয়ে সম্মতি সূচক হাসি হেসেছিলেন।

আমিও তাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। তখন অনেক নারী আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলেন, অনেকে বলেছিলেন- ‘মাশাল্লা, আলহামদুলিল্লাহ।’

নীল স্কার্ফ পরিহিত একজন নারী জানতে চেয়ে বলেন, ‘আপনি কি ইসলামিক শিক্ষা নেয়ার জন্য আসতে পারবেন’?

আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি জানি না।’ তখন তিনি বললেন, ‘আপনাকে স্বাগতম।’ আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খুশি মনে ঘরে ফিরে এলাম।

আমি ঘরে ফিরে এসে আমার মাকে জানাই যে, আমি নতুন কিছু শিখতে যাচ্ছি কিন্তু ইসলাম সম্পর্কিত কিছু তাকে বলি নি। এর পরে আমি মসজিদে গিয়ে ইসলামি শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হই।

পরিচয় লুকানো
পাঠ শুরু হওয়ার প্রথম দিনে আমি অপেক্ষা করতে থাকি কখন আমার মা কাজে যাবেন। এর পর আমি নিজেকে তৈরী করে নিই। আমি মুসলিম নারীদের সাথে একসাথে হওয়ার জন্য একটি গোলাপি স্কার্ফ পরিধান করি এবং লম্বা কালো একটি স্কার্ট পরিধান করি।

ঘর থেকে বের হয়ে আমি খুব ভীত ছিলাম এই ভেবে যে, যদি কেউ আমাকে হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেখে ফেলে এবং আমার মা বাবাকে এ কথা বলে দেয়।

যখন আমি এসে পৌঁছাই তখন আমি নিজেকে সেখানকার পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিই। প্রথম পাঠ ছিল আরবি ভাষার উপর এবং দ্বিতীয় পাঠে আমরা পবিত্র কুরআন সম্পর্কে জানতে পারি।

ঘরে ফিরে আসার সময় আমি মসজিদের পাশের একটি ইসলামিক দোকানে যাই এবং সেখান থেকে আমি একটি নিকাব ক্রয় করি যাতে আমি আমার চোখ ছাড়া পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে পারি।

আর সপ্তাহ পার হওয়ার সাথে সাথে আমার মায়ের ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা আমার জন্য একটি দৈনন্দিন কাজে পরিণত হয় এবং এর পর আমি নিকাব পরিধান করে ইসলামিক শিক্ষা নেয়ার জন্য রওয়ানা হই।

সেখানে আমার শিক্ষক আমার সাথে মারিয়াম এবং সুমাইয়া নামের দুজন মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তাদের বন্ধুতে পরিণত হই এবং তারা আমাকে কাবা শরিফের একটি রেপ্লিকা উপহার দেয়।

আর ইসলামিক শিক্ষার পাঠ গুলোতে অংশ নেয়ার পরে আমি বুঝতে শুরু করি যে, আমি এখন আর আমার বিশ্বাস লুকাতে চাই না। এভাবে একদিন আমি আমার বন্ধু মারিয়ামকে জানাই যে, আমার বিশ্বাস সম্পর্কে আমি মা বাবা কে এ বিষয়টি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মারিয়াম জানতে চেয়ে বলেন- ‘কখন তোমার মা বাবাকে এ বিষয়টি জানানো উচিত বলে তুমি মনে কর?’

আমি জানাই- ‘আমি ঠিক জানি না। আমি ভয়ে আছি, যদি তারা আমার সাথে খারাপ আচরণ করে।’

মারিয়াম বলেন- ‘আমি জানি এটি সহজ নয় এবং আমি যদি কখনো আমার পিতা মাতাকে ধর্ম ত্যাগের কথা বলি তখন তারা অবশ্যই খারাপ আচরণ করবে। কিন্তু তোমার সৃষ্টিকর্তা কে?’
আমি উত্তরে জনাই- ‘আল্লাহ’

মারিয়াম জানায়- ‘ঠিক। তুমি যখন মৃত্যুবরণ করবে তখন তোমার সাথে কে থাকবে? বিচার দিবসে তোমাকে কে রক্ষা করবে?’

আমি উত্তর দিই- ‘আল্লাহ।’

মারিয়ার এর পর জানান- ‘ইসলামে পিতা মাতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আল্লাহর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি তোমার পিতা মাতাকে জানিয়ে দাও। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন।’

সূত্র: হাফিংটন পোষ্টে প্রকাশিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণকারী নারীর কলাম থেকে।

captcha