IQNA

পূর্বে ইহুদিবিদ্বেষ আর এখন ফিলিস্তিনিবিদ্বেষ?

কেন জার্মান সরকার হিটলারের উদাহরণ পুনরাবৃত্তি করছে?

3:07 - March 17, 2024
সংবাদ: 3475247
ইকনা: বার্লিনের ফ্রেই ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের একটি দল গত ১৪ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করে একটি সমাবেশের আয়োজন করেছিল। জার্মানিতে নজিরবিহীন ওই সমাবেশ অনুষ্ঠানে কেউ কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যদিও তা ভালোভাবে শেষ হয়নি!

ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা পুলিশ ডেকে এনে আন্দোলনরত ২০ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উভয়েই বলেছেন যে ছাত্রদের এই বিক্ষোভে ইহুদি বিরোধী বা বর্ণবাদী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে তারা এটাও জানিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থীদের ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচিকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এমনকি তাদের জার্মান থেকে বহিষ্কারের জন্য ২৬ হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত সম্বলিত একটি আবেদনপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।

১৪ ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানিয়ে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং এরপর এ ইস্যুতে গণমাধ্যমকে হয়রানির ঘটনা এমন সময় ঘটেছে যখন জার্মানির সরকার ও কিছু উগ্র ব্যক্তি ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রদর্শনকারী যে কারো উপর হামলা করে যাচ্ছিল। ফিলিস্তিনের সমর্থনে যেকোনো সমাবেশ আয়োজনকারীদেরকে এবং ইসরাইলের কট্টর সমর্থক হিসাবে পরিচিতি জার্মানির সরকারের সমালোচনাকারী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিকে ভয়ভীতি, আতঙ্ক সৃষ্টি, তাদেরকে হয়রানি করা, নির্যাতন করা কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে।  

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই নিপীড়নের মূল লক্ষ্য হল হলোকাস্টের মতো কলঙ্কজনক ঘটনার মতো জার্মানির অতীত অপরাধ থেকে নিজেদের বের করে আনা।

তাদের স্পষ্ট বার্তা হচ্ছে, ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জার্মানি সরকারের ব্যতিক্রমী অবস্থান।

যদিও বর্তমান জার্মানি সরকার নাৎসি যুগের বিরুদ্ধে, কিন্তু আজ তারা নাৎসিদের মতোই একই আচরণ করছে তবে তা ভিন্ন উপায়ে ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে। অর্থাৎ তারা অতীতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় এভাবে।

এখন পর্যন্ত, বহু সংখ্যক ইহুদি লেখক ও পণ্ডিত প্রায়শ্চিত্তের এই পদ্ধতির কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন।

এমিলিয়া রোইগ হচ্ছেন একজন ফরাসি ইহুদি গবেষক ও লেখক। তিনি প্রায়শ্চিত্তের এই ধরণ বা পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যকের মধ্যে এক ধরনের ইহুদি বিদ্বেষ আছে কিন্তু এটাকে ঠিক ইহুদিবিদ্বেষ হিসাবে অভিহিত করা যায় না। ইহুদিবিদ্বেষী এই ক্ষুদ্র অংশ জার্মানির বৃহত্তর অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না।


অন্যদিকে, আরেক ইহুদি লেখক ও গবেষক এমিলি দিশ বেকার বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার কারণে যাদেরকে ইহুদিবিদ্বেষের মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদেরকে অপসরণ বা বহিষ্কার করা হচ্ছে খোদ ওরাই ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক যারা ছিল হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ।

প্রকৃতপক্ষে, কথিত প্রায়শ্চিত্তকারীরা মূলত ইহুদিদের নিরাপত্তার কথাও চিন্তা করে না। যদি তারা ভাবতো তাহলে যখন ইহুদি, আরব কিংবা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলতো তখন তারা তা প্রতিহত করতো। কিংবা যাদের প্রতি সংহতি দেখানোর প্রয়োজন তখন তারা সংহতি দেখাতো।  কিন্তু তারা তা করছে না।

এমনকি, কথিত ইহুদি নিধন ইস্যুতে প্রায়শ্চিত্তকারীরা জার্মানিদেরকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান নিতে বাধা দেয়। অথচ এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলা  যেকোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব, বিশেষ করে জার্মানি সরকারের এ দায়িত্ব মেনে চলা উচিত।


ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভকারীর হাতে একটি প্ল্যাকার্ড যাতে লেখা আছে, একটি হলোকাস্ট আরেকটি গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। 
দখলদার ইসরাইলের সরকার ও সামরিক বাহিনী নির্দ্বিধায় এবং নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে তাদের গণহত্যার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের বিষয়টি ঘোষণা করেছে।

কিন্তু তারপরও  জার্মান সরকার এবং দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল ইসরাইলের এ উদ্ধতকে উপেক্ষা করে চলেছে। এমনকি তারা গাজা ইস্যুতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়কেও উপেক্ষা করেছে। ইসরাইল গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের বর্ণবাদী আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো একমত হলেও জার্মান সেটাকে অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। 

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কথিত প্রায়শ্চিত্তের অনুভূতি জার্মানির সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এরফলে তাদের বর্ণবাদী আচরণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং তারা পশ্চিম এশিয়ায় বর্ণবাদী  ইসরাইলের জুলুম নির্যাতন ও আগ্রাসনকে চোখ বুজে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

একইভাবে কথিত প্রায়শ্চিত্তের অনুভূতি জার্মানিকে বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদকে ধামাচাপা দেয়ারও সুযোগ এনে দিয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, জার্মানির একটি ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে, তাদের বর্ণবাদী আচরণের ধরণ শুধু পাল্টেছে। অর্থাৎ এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে আরব বিরোধী ও ইসলাম বিরোধী যে আবহ তৈরি হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজের যে অবহেলা রয়েছে তারই সুযোগ নিচ্ছে জার্মানি।   প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের আচরণের কারণে একটি জাতির ওপর বংশনিধনযজ্ঞ চালানোর পটভূমি তৈরি হয়েছে। যার বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে গাজায় চলমান গণহত্যা। 

সম্প্রতি জার্মানির কোলন শহরে খ্রিস্টানদের ঐতিহ্যবাহী 'কার্নিভাল' উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই উৎসবে একজন ফিলিস্তিনি নারীর ছবি দেখানো হয় যার মাথায় স্কার্ফের মতো দেখতে বড় সাইজের ক্যাফিয়া বা রুমাল রয়েছে। তার হাতে 'ঘৃণা' ও 'সহিংসতা' নামের দুটি কুকুরকে ধরে রাখার একটি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এই কুকুরগুলোর গলার বেল্টও তৈরি করা হয়েছিল ফিলিস্তিনের পতাকা দিয়ে। এ ভাবে তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ এবং ইসরাইলের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে।

জার্মানির আরেকটি বর্ণবাদী আচরণের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বার্লিনের স্কুলগুলোকে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল দ্বারা সংঘটিত ন্যক্কারজনক নাকাবা বা বিপর্যয় দিবসকে কল্পকাহিনী হিসাবে বর্ণনা করে লিফলেট বিতরণের জন্য বলা হয়েছে।


নাকাবা দিবসের একটি ঐতিহাসিক চিত্র, যেদিন লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে এতোবড় বিপর্যয়ের ঘটনায় জার্মানির কোনো একাডেমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা মানবাধিকার বিষয়ক কোনো সংগঠন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। অথচ সমাজের বিবেক শ্রেণী হিসাবে তাদের উচিত ছিল ইসরাইলের ওই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং বর্তমানে ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে আয়োজিত ডিবেট বা আলোচনার বিরোধিতা করা। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।#

পার্সটুডে

captcha